আমি সবসময় সবাইকে মানবিক হতে বলি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, একজন মানুষের গন্তব্য হওয়া উচিত মানবিকতা ও নৈতিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়; যদিও মানবিকতা বা নৈতিকতা একটু আপেক্ষিক বিষয়। মানুষ এই গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণি, তার আচরণ ও ব্যবহারও হওয়া উচিৎ সকল প্রাণি থেকে আলাদা; কিন্তু আদতে সেটা একেবারেই উল্টো। 

কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছে, মানুষের ভিতর থেকে মানবিকতা বিষয়টা উঠে যাচ্ছে (তবে সবাই না)। উঠে যাচ্ছে বললে ভূল হবে, বলতে হবে যে রুপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে মানুষ এবং পশুর চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, মানুষ যেটাকে মানবিকতা বলে সেই চরিত্রটাই পশুর ভিতরে রয়েছে, আর যেটা পশুর চরিত্র হবার কথা সেটা এখন মানুষের। অর্থাৎ মানুষ হয়ে যাচ্ছে পাশবিক আর পশু হয়ে যাচ্ছে মানবিক। মানুষের জীবনের কিছু আচরণ বা ঘটনা নিয়ে পর্যালোচনা করা যাক-

খুন

খুনের ক্ষেত্রে মানুষ মনে হয় অদ্বিতীয় যারা নিজের স্বজাতিকে হত্যা করতেও দ্বিধা করেনা। সামান্য স্বার্থসিদ্ধির জন্যেও খুন হয়। কিন্তু পশুদের মধ্যে এই গুনটা(!) নেই। এরা হয়তো সামান্য সময়ের জন্য একটু মারামারি করে, কিন্তু কখনো মেরে ফেলেনা।

যদিও মাংসাশী প্রাণিরাও অন্য প্রাণিকে হত্যা করে, তবুও সেটা শুধুমাত্র আহারের জন্য, নিজে বেঁচে থাকার তাগিদে। কিন্তু মানুষ শুধু বেঁচে থাকার জন্যই নয়, শখের বশেও অন্য নিরীহ প্রাণিকে হত্যা করে খায়।

মানুষ হায়েনাকে হিংস্র প্রাণি বলে, আমিতো দেখি মানুষের মত হিংস্র প্রাণি দ্বিতীয়টি নেই।

ধর্ষণ

ধর্ষণের কথা আর নাই বা বলি। পুরুষ প্রজাতিরা নাকি রাস্তায় যখন তখন নারী প্রজাতিদেরকে দেখেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। একা পেলে নাকি সম্পত্তি মনে করে, হক আদায় করে! বাদ যায়না শিশুরাও! অদ্ভুদ লাগে!

অন্যদিকে পশুদের মাঝে কিন্তু এই লাগামহীন যৌনতা নেই। তাদের দৌড় নির্দিষ্ট সময়ে প্রজাতির ধারা বা বংশগতি রক্ষা পর্যন্তই। কুকুর পাগল হয় ভাদ্র-আশ্বিন মাসে, আর মানুষের! তাদের সারা বছরই ভাদ্রমাস!

লোভ

মানুষের চাওয়ার কোন শেষ নেই। লোভ তার শিরায় শিরায় বহমান। অর্থের লোভ, ক্ষমতার লোভ, খ্যাতির লোভ… ; এ তালিকার সমাপ্তি নেই। লোভ নেই এমন মানুষ আজকাল খুজে পাওয়াই দুষ্কর। কিন্তু পশুর ভিতরে আমি কোন লোভ দেখতে পাইনা। একটা বাঘ যখন কোন শিকার করে তখন সে শুধু একটা পশুকেই শিকার করে, যতটুকু সে খেতে শেষ করতে পারে। কিন্তু মানুষ হলে কি করত? পালের সবগুলোকেই শিকার করে বসে থাকত। সে যে এটা খেতে পারবে সেটা বড় বিষয় না, বিষয় হচ্ছে তার লোভটা তাকে তাড়িত করছে।

কৃতঘ্ন

মানুষ অকৃতজ্ঞ, কাজ হয়ে গেলে উপকারকারীর কথা আর মনে রাখে না। বরং খুজতে থাকে কখন উপকারকারীকে ক্ষতি করা যায়। মানুষকে উপকার করে কখনো তৃপ্ত করা যায়না। অভুক্তকে ভাত দিলে বলে মাংস দিল না কেন, মাংস দিলে বলে সালাদ দিলনা কেন, সালাদ দিলে বলে মাখিয়ে খাইয়ে দিলনা কেন। সবচেয়ে বড় কথা কাউকে যদি ১ বছর ধরে সাহায্য করার পরে শুধু একটা কাজে অপারগতা দেখান হয় তাহলে সেই কথাটাই মনে রাখে, ১ বছরের উপকারের কথা মনে রাখে না।

অন্যদিকে পশুকুল সবসময়ই কৃতজ্ঞ। একটা পোষ্য কুকুরকে যদি লাথিও মারেন তাহলেও সে ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে যায়না। রাত জেগে বাড়ি পাহারা দেয়। এমনকি রাস্তার কুকুরকেও যদি এক সপ্তাহ খেতে দেন, সে আপনার বাড়ি ছেড়ে যাবেনা।

হিংসা-বিদ্বেষ

হিংসা-বিদ্বেষ মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য সরাসরি প্রত্যক্ষ কোন কারণের প্রয়োজন নেই। আমার বন্ধুর সাথে আর একজনের শত্রুতা থাকলে সেও আমার শত্রু হয়ে যায়। কি আশ্চর্য! তাই না?

পশুর ভিতর এমনটি দেখা যায়না। মারামারি করে এসে একই ঘাটে জল খাওয়া এদের জন্য খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে কোন চরিত্রটা বেশি অনুকরণীয়? তাহলে এখন আমার স্লোগান কি হওয়া উচিৎ? সবাইকে মানবিক হতে বলা নাকি পাশবিক হতে বলা?

আক্ষেপঃ একদিন আমি আর আব্বু রাস্তা দিয়ে হেঁটে কোথায় যেন যাচ্ছিলাম, তখন আমি ষষ্ঠ অথবা সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। সময় পেলেই আমরা দেশ ও দশের আলোচনা করি। কথায় কথায় আমি বললাম – “মানুষ তো সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণি, তাইনা?” আব্বু হঠাৎ করে বলে উঠল – “কিভাবে? তুমি কেন মনে কর যে মানুষই সেরা প্রাণি? তুমি কি আমেনার (আমাদের একটা গরু ছিল, তার নাম) সাথে কথা বলে শিওর হয়েছো?” চলতি রাস্তায় আমি থমকে গেলাম। আব্বুর কথার উত্তর দিতে পারলাম না। এখনো পারিনি। এই কথাটা আমার প্রায়ই মনে পড়ে আর উত্তর খুঁজি।

আশাঃ আমি সবসময়ই আশা করি একদিন আমার আব্বুর সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারব ঠিক কি কারণে মানুষ সেরা। শুধু দরকার একটা পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তনটা হবেই…

0 0 votes
Article Rating
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x