ঘরের ভিতর থেকে দেখলে মনে হয় পৃথিবী সমতল; যখন কোন মরুভূমির তপ্ত বালু বা পিচ রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে মরীচিকা দেখা হয় তখনও মনে হয় পৃথিবী সমতল। কোন নাবিক যখন সমূদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে দূরবীন দিয়ে অনেক দূরের জিনিস দেখার চেষ্টা করে তখন মনে হয় পৃথিবী বাঁকা; যখন কোন বৈমানিক উপর থেকে দেখে, তখনও মনে পৃথিবী বাঁকা। কিন্তু একজন নভোচারী কি দেখতে পায়? সে দেখতে পায় পৃথিবী গোলাকার। সেই ই প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর স্বরুপ দেখতে পায়।
কোন কিছু দেখতে হলে বা উপলব্ধি করতে হলে, তার সীমানা অতিক্রম করে দেখতে হয়।
কিন্তু এই নভোচারী ছাড়া কি কারো পক্ষেই পৃথিবী গোলাকার এটা জানা সম্ভব নয়? অবশ্যই সম্ভব। প্রথম নভোচারীর অনেক আগেই মানুষ জেনেছে পৃথিবী গোলাকার। কিভাবে জেনেছে? তারাও এই পৃথিবীর সীমা অতিক্রম করে দেখেছে। তারা এই সীমা অতিক্রম করেছে তাদের জ্ঞান দিয়ে, তাদের চিন্তাশক্তি দিয়ে, তাদের মেধা দিয়ে। ইংরেজীতে একটা কথা আছে – “Bird’s Eye View”, অর্থ্যাৎ উপর থেকে দেখা (অবশ্য আমি “God’s Eye View” দিয়েই দেখতে পছন্দ করি)। এই উপর থেকে দেখার জন্য, আমাদের কে উপরে উঠতে হবে। আর উপরে ওঠার সিঁড়ি হচ্ছে- চিন্তা করা, জ্ঞানার্জন করা, বোধের বিকাশ ঘটানো।
যারা এই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেছে তাদেরকে আমাদের সমাজে জ্ঞানী বা বুদ্ধিজীবী বলা হয়। তারা উপর থেকে সবকিছু দেখতে পায়, অনেক কিছু অনুভব করতে পারে। তাদের কথা বলা উচিৎ। তারা কথা না বললে অযোগ্য ব্যক্তিরা তাদেরকে অবরুদ্ধ করে ফেলবে, কারণ তারাই তো সংখ্যাগরিষ্ঠ; যার প্রমাণ আমরা প্রতিনিয়তই পাচ্ছি। ন্যায় হয়ে গেছে অন্যায় আর অন্যায় ন্যায়। জ্ঞানীরা হয়ে গেছে কোণঠাসা। তারা অনেক কিছুই জানেন; কিন্তু বলেন না। সমাজে এত এত অরাজকতা! তারা নীরব। এত এত দুর্নীতি!, তারা নীরব। এত কুসংস্কার, তারা নীরব। কেন? কেউ কেউ অবশ্য মাথা বাঁচিয়ে কিছু কিছু বলে, কেউ আবার সরাসরি দালালি করে। এই মাথা বাঁচিয়ে চলা লোকেরা পায় “সুশীল” উপাধি আর স্পষ্টভাষীরা পায় “উচ্ছৃঙ্খল” বা “ভ্রষ্ট” তকমা। উদাহরণস্বরুপ আমি এখানে দুইটি বাক্য বলছি–
১। আমার এই লেখাটা, অধিকাংশ পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠী বা জ্ঞান বিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকা লোকেরা বুঝতেই পারবে না।
২। আমার এই লেখাটা, অধিকাংশ মূর্খই বুঝতে পারবে না।
এই দুইটা বাক্যের ভাবার্থ একই, বলার ভঙ্গিমা ভিন্ন। ১ নম্বর বাক্যটা কিছু কিছু লোক বুঝতে পারবে; কিন্তু ২ নম্বর বাক্যটি যে সবাই বুঝতে পারবে এটাতে কোন সন্দেহ নেই। দুই নম্বর বাক্যটি বললে আমার মাথা থাকবে না; কিন্তু আমি যাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলছি তারা তো দুই নম্বর বাক্য ছাড়া বুঝতে পারবে না। এটা একটা উভয় সঙ্কট। তবে ১ নম্বর বাক্যের মত করে হলেও বুদ্ধিজীবী দেরকে এগিয়ে আসা উচিৎ, অন্তত দালালি করার চেয়ে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে এথেন্সের রাস্তায় এক উস্কো-খুষ্কো, নাক বোঁচা, বেঁটে, কুৎসিত লোক ঘুরে বেড়াতেন; নাম তার সক্রেটিস। যুব সমাজকে পথভ্রষ্ট করার অপরাধে তাকে হেমলক বিষ পান করিয়ে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগটা খুব সামান্য ছিল, ইচ্ছা করলে পালিয়েও যেতে পারত; কিন্তু তিনি পালাননি। তিনি বলেছিলেন – পালিয়ে যাওয়া মানে মৃত্যুভয়, যা কোন দার্শনিকের থাকা উচিৎ নয়। তিনি পালাননি, মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করেছেন; কিন্তু তাকে নিয়ে আজও দর্শনের শিক্ষার্থীরা গবেষণা করে। তাকে তখনকার ক্ষমতাসীন লোকেরা মিথ্যা প্রমাণ করতে চেয়েছিল, কিন্তু কালের বিবর্তনে তিনিই হয়ে গেলেন আদর্শ।
পূর্বে ধারনা করা হত, পৃথিবীকে কেন্দ্র করেই সমস্ত গ্রহ নক্ষত্র ঘোরে। সর্বপ্রথম “টলেমি” বলেন যে সূর্যের চারিদিকেই পৃথিবী ঘোরে। এই ঘটনা জ্যোতির্বিদ “ব্রুনো”র কাছে সঠিক বলে মনে হল। সেও একই কথা বলল। কিন্তু ব্রুনোর ভাগ্য অতটা সুপ্রসন্ন ছিলনা। ব্রুনো ছিল রোমান নাগরিক, আর রোমান পাদ্রিরা অনেক গোঁড়া ছিল। শেষপর্যন্ত ১৬০০ সালে তাকে পুড়িয়ে মারেন ঐ পাদ্রীরা। তাতে কি হয়েছে? সূর্য কি পৃথিবীর চারপাশে ঘোরা শুরু করেছে? করেনি। সত্য কখনো চাপা থাকে না। সবসময় যুক্তি আর বিজ্ঞানের জয় হয়েছে। সবকিছু সময়ের অপেক্ষামাত্র।
মানুষ মরে না। যারা মরে তারা জানে না মৃত্যু কি।
ইতিহাস থেকে দেখতে পাই, যারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, যারা জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিন্তা ও মননে সেরা, তারা সবসময়ই ঐ সময়ে নিগৃহীত, অধিকাংশ লোকের কাছেই নিন্দনীয়। এর কারণ কি? কারণ হচ্ছে, অধিকাংশ মানুষই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, যেটা আছে সেটা নিয়েই থাকতে পছন্দ করে, তারা বদ্ধ, মোহবিষ্ট, ক্ষণিকের লোভ লালসায় বুঁদ, শৃঙ্খলিত, তারা পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতে পারে না।
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান যারা, তারা কখনো সেই সময়ের জন্য জন্ম নেয় না, তারা জন্মায় পরবর্তী শতাব্দীর জন্য, তারা বেঁচে থাকে মানুষের অন্তরে।
সত্যকে স্বীকার করা, সত্যকে মেনে নেওয়া আর সত্য বলার চেয়ে বড় মুক্তি নেই। তবে, সত্য বলাটা মোটেই সুখকর কোন বিষয় নয়, সত্য বলতে গেলেই বিপদ। এই সমাজ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, এই কুসংস্কারের ভিড়ে সত্য মেনে নেওয়া অত সহজ নয়। এই কুসংস্কারের চর্চা আর গোঁড়ামি চলে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে, কোন পরিবর্তন নেই। সমাজ থেকে এক কুসংস্কার বিতাড়িত হয়েছে, নতুন এক কুসংস্কার জাপকে ধরেছে। এর যেন কোন শেষ নেই…