মানুষ যে অন্যান্য প্রাণি থেকে আলাদা বা আজ আমরা যে প্রযুক্তির চরম শিখরে পৌছেছি তার অন্যতম প্রধান কারণ হল ভাষার ব্যবহার। অন্যান্য প্রাণির শব্দভান্ডার এত সমৃদ্ধ নয়, তারা নিজের লব্ধ জ্ঞানকে অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে পারেনা- যেটা মানুষ পারে। এক এক সমাজ সংস্কৃতির জন্য আছে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা। তেমনি হাজার হাজার ভাষার মাঝে “বাংলা” একটি অন্যতম বহুল ব্যবহৃত ভাষা।

ছোটবেলায় যখন কথা বলতাম তখন কখনো ভুলেও চিন্তা করিনি যে ভাষা কি, এর ব্যবহারই বা কি। বিষয়টা এমন যেন আমি যেমন হাত পা নিয়ে জন্মেছি, তেমনিভাবে ভাষাটাও একটি জন্মগত ব্যাপার। একটু বড় হবার পর বুঝলাম, পৃথিবীতে অন্যান্য ভাষাও আছে। বুদ্ধি হবার পর ভাষার জন্য ভাষা শহীদদের আত্নত্যাগের কথা পড়লাম, আমাদের ভাষার শ্রেষ্ঠত্বের গল্প শুনলাম। আমরা যে এই ভাষা নিয়ে গর্ববোধ করি এটা কি এতটুকুই, নাকি এর পরিসর আরো ব্যপক। কোন যুক্তিবাদী মন কি এটুকুতেই সন্তুষ্ট হতে পারবে? বাংলা ভাষা আমাদের আবেগের জায়গা, এর বাইরে কি ভাষা নিয়ে গর্বের কিছু আছে?

প্রায় বছর খানেক হল এই বিষয়টা নিয়ে আমার মাথায় মাঝে মাঝেই প্রশ্ন জাগে। আমি যতবারই এটা নিয়ে ভাবি ঠিক ততবারই বিস্মিত হই। আমাদের বাংলা ভাষা আসলেই অন্যান্য ভাষার থেকে আলাদা এবং গর্ব করার মত অনেক কিছুই আছে। আজকে দু’টি বিষয় নিয়ে কথা বলি-

বাংলা ভাষা ব্যবহার করে শ্রদ্ধা বা বিনয় প্রকাশ করা যায়। যেমন বয়সে বড় কাউকে সম্বোধন করতে “আপনি”, সমবয়সি বা বয়সে ছোট কাউকে “তুমি”/”তুই” ব্যবহার করা হয়। যেটা ইংরেজি তে শুধু “You” দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এখানে বোঝার উপায় নেই কে ছোট বা বড়। এই গুনটি অবশ্য এশিয়া মহাদেশের অনেক ভাষাতেই আছে। যেমন কোরিয়ান ভাষায় বয়সে বড় কাউকে কিছু বলার জন্য 입니다, সমবয়সী বা বয়সে ছোট কাউকে কিছু বলার জন্য 이에요/예요 এবং 이/이야 ব্যবহার করা হয়। এটা কিছুটা জাতিগত বৈশিষ্টের উদাহরণ। আমার মনে হয় সামগ্রিকভাবে এশিয়া মহাদেশের মানুষের মধ্যে নমনীয় ভাবটা একটু বেশি, যার ফলে বয়সে ছোট বা বড় কারো সাথে কথা বলার জন্য ভিন্ন ভিন্ন উপায় তৈরি হয়েছে।

দ্বিতীয় বিষয়টা অনেক সমসাময়িক। আশ্চর্যজনক ভাবে বাংলা ভাষা লিঙ্গ নিরপেক্ষ। অনেক ভাষাতে সর্বনাম ব্যবহারের সময় অনেক সতর্ক থাকতে হয়। বাংলা ভাষায় সর্বনামের ক্ষেত্রে “সে” ব্যবহার করলেই হয়ে যায়, ঝামেলা শেষ। কিন্তু ইংরেজিতে He/She/They বা কোরিয়ান এ 그/그녀/그들 ব্যবহার করতে হয়। সমস্যা হয় যখন সে দেখতে ছেলের মত কিন্তু নিজেকে মেয়ে বলে দাবি করে, সেক্ষেত্রে তাকে যদি আমি He বলি তাহলে সে মনঃক্ষুণ্ণ হয়। আবার অনেকে নিজেকে ছেলে এবং মেয়ে দুইটাই মনে করে সেক্ষেত্রে They ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু বাংলায় এ ধরনের আলাদা আলাদা কোন শব্দ নেই। হাজার হাজার জেন্ডার তৈরি হলেও কিন্তু “সে” শব্দ ব্যবহার করলেই হল, দ্বিতীয়বার চিন্তার কোন দরকার নেই। লিঙ্গ নিরপেক্ষতার বিষয়টা অনেক কাকতালীয় হলেও আমার কাছে খুবই দারুণ লেগেছে। বাংলা ভাষার রুপকার রা কি ভবিষ্যৎ জেনেই এমন একটি সর্বনাম পদ্ধতির দিকে এগিয়েছিলেন?!

ছোটবেলার “মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা” র মর্মার্থ বুঝতে না পারলেও এখন ঠিকই বুঝি। আমাদের এমন একটি ভাষা আছে যা নিয়ে সত্যিই গর্ব করা যায়। মহান একুশে ফেব্রুয়ারিতে সকল ভাষা শহীদদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।

0 0 votes
Article Rating
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x